কবিতা পাঠকের শরীর ও আত্মায় নীরব ঢেউ তোলে। ‘মুখস্থ হয়নি তো তোমার স্বগত সংলাপ’ তেমনই এক কাব্যগ্রন্থ, যা নিছক কবিতার সংকলন নয়, বরং এক ধরণের অভ্যন্তরীণ চৈতন্যের পুঞ্জিভূত ভাষ্য। কবি দীপশেখর চক্রবর্তী এখানে কেবল কবিতাই লেখেননি, তিনি নিজের নিঃশব্দ, বিষণ্ন, কিন্তু প্রগাঢ় অনুভবগুলোর চিত্র তুলে ধরেছেন, যেন প্রতিটি কবিতা একেকটি আত্মস্বীকারোক্তি।
দীপশেখর চক্রবর্তীর এই সংকলন মূলত গদ্যকবিতায় লেখা হলেও, তার ছন্দ ছড়িয়ে আছে নীরবতার ভেতরে। শব্দ যেখানে থেমে যায়, সেখানে শুরু হয় তাঁর কবিতার প্রকৃত উচ্চারণ। কখনো কখনো কাব্যগুলো এতটাই বিমূর্ত ও নিজস্ব অভিজ্ঞতায় মোড়া যে প্রথম পাঠে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হতে পারে। কিন্তু পাঠকের ধৈর্য থাকলে, দীপশেখর চক্রবর্তী তাকে বারবার নতুন করে ফেরত ডাকেন,আরো গভীরে, আরো নিঃসঙ্গ কোনো ঘরের দরজার সামনে।
এই বইয়ের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল এর প্রতীকচিন্তা। দীপশেখর চক্রবর্তীর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে ছাদ, আয়না, চিলেকোঠা, বালতির জল, টব, বিছানার চাদর, কিংবা এমনকি একটুকরো পিঁপড়েও। এই ছোট ছোট জিনিসগুলো তাঁর কবিতায় হয়ে উঠেছে মানুষের চেতনার প্রতিবিম্ব।
যেমন:
“ঘরের মতো করে আমিও জেনেছি / আশ্রয় দিয়েছে যে শূন্যতা তার কোনও বন্ধু নেই / শুধুই ভাড়াটে সর্বদা প্রস্তুত… একটি তীক্ষ্ণ পেরেক।”
এখানে দীপশেখর চক্রবর্তী গৃহকে ব্যবহার করছেন আত্মিক নীড় বা অভিমানী শরীরের প্রতীকে।
দীপশেখর চক্রবর্তীর কাব্যে প্রেমের ব্যাখ্যা কখনও সরল নয়। বরং প্রেম এখানে অনুপস্থিতির মধ্যে গড়ে ওঠা এক সংলাপ।
যেমন:
“একটি বয়সের পর / ভালোবাসা / শুধু এক আঁজলা জল / আর মুখ ধুয়ে নিতে পারা।”
এই পঙ্ক্তিগুলো শুধুই দার্শনিক নয়, একান্ত ব্যক্তিগত এক উপলব্ধি। পাঠকের নিজস্ব জীবনানুভবের সাথেও তা গেঁথে যায়।
নারীর অভিজ্ঞতা ও প্রেম-প্রত্যাশার প্রকাশে দীপশেখর চক্রবর্তী নিছক সংবেদনশীল নয়, রাজনৈতিকভাবে সচেতনও।
যেমন:
“তুমি হাঁটু মুড়ে বসো হে পুরুষ কবি / একজন মেয়েমানুষের উথালপাতাল ভালোবাসা ছাড়া / তুমি কতটা দুর্বল, অর্থহীন ও একা।”
এই পঙ্ক্তি কেবল পুরুষ কবিকে নয়, কবিতাজগতের একপ্রকার পুরুষতান্ত্রিক ‘আধিপত্যকেও’ প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আবার একটি বিস্ময়কর পঙ্ক্তিতে তিনি বলেন,
“আমাদের বাড়ি থেকে যেমন কিছুদূর গেলে বাংলাদেশ / তেমনই আমার ভেতর থেকে কিছুদূর গেলে তুমি বসে আছ।” এটি শুধুই এক অনবদ্য উপমা নয়, বরং দীপশেখর চক্রবর্তীর নিজস্ব অনুভবমণ্ডল, যা ভূগোল ও মনের মানচিত্রকে একসঙ্গে নিয়ে আসে।
এই কাব্যগ্রন্থে একধরনের বিষণ্নতা রয়েছে, কিন্তু তা ক্লান্তিকর নয়। বরং দীপশেখর চক্রবর্তীর বিষণ্নতা এক প্রকার জিজ্ঞাসামূলক প্রশান্তি।
যেমন তিনি বলেন,
“যে চলে যায়, সে কোথায় যায়? যে থাকে, সে থাকে কোথায়?”
এই প্রশ্ন শুধুই অনুপস্থিতির নয়, আত্মপরিচয়েরও।
সব মিলিয়ে, দীপশেখর চক্রবর্তীর ‘মুখস্থ হয়নি তো তোমার স্বগত সংলাপ’ একটি অসামান্য সংযোজন, যা সমকালীন বাংলা কবিতার ভেতরে এক নিরব বিপ্লব ঘটায়। এটি এমন এক কাব্যগ্রন্থ, যেখানে কবি নিজেকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়ে প্রতিটি পাঠকের সামনে রেখে দেন। আর সেই ভাঙনের শব্দ শোনা যায় না শুধু অনুভব করা যায়।
এটি এমন একটি বই, যা বারবার পড়তে ইচ্ছা করে। প্রতিবার নতুন কিছু আবিষ্কার হয়। দীপশেখর চক্রবর্তীর কবিতা পাঠককে তাড়িয়ে ফেরে, কিন্তু সঙ্গও দেয়। এই বিরল অভিজ্ঞতা বাংলা কবিতায় খুব কমই আসে।
অবশেষে বলা যায়, দীপশেখর চক্রবর্তী কেবল একজন কবি নন, তিনি এক নিঃশব্দ ভাষার নির্মাতা যেখানে আত্মা এবং শরীর একসাথে কবিতা হয়ে ওঠে।
রিভিউ:- রওনক জাহান মুন