একজন অবহেলিত রাজনীতিবিদ এবং একটি রাষ্ট্রের জন্ম


 

একজন অবহেলিত রাজনীতিবিদ এবং একটি রাষ্ট্রের জন্ম

 

সোহরাওয়ার্দী নামটা শুনলেই আমাদের মানসপটে একজন ক্লিন সেভড মধ্যবয়সী রাজনীতিবিদের ছবি ভেসে ওঠে। পুরো নাম ”হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী”, জন্ম বর্তমান পশ্চিমঙ্গের মোদিনীপুরে ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে। ছিলেন একাধারে অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্টাতাদের একজন। চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে বারবার হয়েছেন আলোচিত, সমালোচিত এবং বিতর্কিত। কিন্তু কখনো আত্মবিশ্বাস হারাননি, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন পরিস্থিতির বিপরীতে। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর শূণ্য হাতে পাকিস্তানে এসে হয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পরবর্তিতে প্রধানমন্ত্রী। একজন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ বলতে যা বোঝায় সোহরাওয়ার্দী তাই।


মুসলমান কুলীন সমাজের সন্তান সোহরাওয়ার্দীর পিতা জাহিদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তৎকালীন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। সেই সূত্রে তিনি প্রথমে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা, সেন্ট জেভিয়াস কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তিতে লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। এখানেই তার সাথে স্বারজ দলের চিত্তরঞ্জন দাস (সি. আর দাস) এর পরিচয় হয়। সোহরাওয়ার্দীর রাজনীতিতে হাতেখড়িও এই সি. আর দাসের স্বরাজ দলের হাত ধরেই।


সোহরাওয়ার্দীর চার দশকের রাজনৈতিক জীবন খুব মসৃনভাবে এগোয়নি। নিজে কুলীন পরিবাররে সন্তান হলেও তিনি সবসময় তৃণমূলের সাথে যুক্ত থেকে রাজনীতি করতে চেয়েছেন। রাজনৈতিক জীবনে প্রথম ধাক্কা খান ১৯২৫ সালে আকষ্মিক দেশবন্ধু সি. আর দাসের মৃত্যুতে। এরপর তিনি মনোনিবেশ করেন শ্রমিক রাজনীতিতে। গড়ে তোলেন কলকাতা ডকার্স ইউনিয়ন। যা পূর্ববাংলার রাজনীতিতে তার অবস্থানকে শক্ত করে এবং ১৯৩৭ সালে গঠিত প্রথম প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রীর পদ পান। এছাড়াও সোহরাওয়ার্দী ১৯২৪ সালে প্রথম স্বারজ পর্টি থেকে কলকাতার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।


মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯০৬ সালে আর সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগে যোগদান করেন তার তিন দশক পর ১৯৩৬ সালে। মূলত সি. আর দাসের মৃত্যুতে সোহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক অবিভাবক শূণ্য হয়ে পড়েন। এরপর ডকার্স ইউনিয়নে শ্রমিক রাজনীতি, খিলাফত আন্দোলন, ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির সাথে যুক্ত হন। এগুলোর কোনটাই তার রাজনৈতিক মনোভাব কিংবা আকাঙ্খার সাথে খাপ খাওয়াতে পারে নাই। তিনি ক্রমেই মুসলমানদের একটি আলাদা রাষ্ট্র বা একটি আলাদা জাতীসত্ত্বার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এসব নানা কারণে তিনি ১৯৩৬ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। সোহরাওয়ার্দীর মুসলিম লীগে যোগদানের ব্যাপারে সবচে’ বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেন মির্জা আবুল হাসান ইস্পাহানি।


১৯৩৫ এর গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টের পর ১৯৩৬ এর প্রাদেশিক নির্বাচনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লীগ বাংলায় কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। এতে সোহরাওয়ার্দী বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলায় কংগ্রেসের উপস্থিতি লোপ পায় এবং এই ধারা অব্যাহত থাকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। আপতদৃষ্টিতে এটি সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানদের সফলতা মনে হলেও এর ভেতরেই বপিত আছে দেশভাগের বীজ। যদিও প্রজা-লীগ কোয়ালিশন সরকারের ১১ জন মন্ত্রির মধ্যে ৫ জন অমুসলিম ছিলেন ।


সোহরাওয়ার্দীর জীবনে ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ এক অদ্ভুৎ সময়। এই সময়ের মধ্যে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা, বড় ব্যার্থতা এবং বড় সমালোচনার সম্মুঙ্খিন হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন কিন্তু সে বছরেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার জন্য আজো তার সমালোচনা করা হয়। যেহেতু তিনি মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন তাই তার ভূমিকাই বড় করে দেখা হয়। বাংলাভাগের ক্ষেত্রেও তার কোনো জোরালো অবস্থান পাওয়া যায় না ১৯৪৭ এর আগে। ৪৭ এর একদম শুরু দিকে এসে তিনি শরৎ বসু, আবুল হাশিম প্রমুখ ব্যক্তিদের সাথে যুক্তবঙ্গের জন্য কাজ শুরু করেন। তবে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জিন্নার জোড়ালে সমর্থনহীনতা এবং কংগ্রেসের মনোভাব ততদিনে বাংলাভাগের পক্ষেই চলে গেছে। এমনকি তারা গান্ধীজির সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলেন।


১৯৪৭ এর দেশভাগের পরেও সোহরাওয়ার্দী কলকাতাতেই থেকে যান। কিন্তু তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের সদস্য, সেই মুসলিম লীগের অস্তিত্ব আর তৎকালীন ভারতে অবশিষ্ট নাই। তাই তিনি ক্রমেই কোনঠাসা হয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালে ভারত সরকারের উপর্যপুরি করের চাপে অনেকটা বাধ্য হয়ে কপর্দকহীনভাবে তিনি পাকিস্তানে আসেন। পাকিস্তানে এসে আবার আইন পেশায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করে নিজের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ঠিক করে নেন। তার প্রত্যক্ষ ইন্ধনেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় যার প্রথম সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হাদিম খান ভাসানী। ১৯৫৩ সালে তিনি এ কে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তিনি নিজেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ক্রমেই প্রাসঙ্গিক করে তোলেন এবং নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে ক্রমেই সুসংহত করেন। সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরেই পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী পররাষ্ট্রনীতির সূচনা হয়। তিনি বিশাল দূরত্বে থাকা একটি দেশের দুই ভাগকে একত্রিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। তিনি বিখ্যাত মারিচুক্তি করেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানকে ৫টি প্রদেশ থেকে ২টি ইউনিটে (পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান) রূপান্তর করেন। তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে পাকিস্তান এটমিক কমিশনের।


যদিও সোহরাওয়ার্দী পকিস্তানের অখন্ডতার জন্য কাজ করেছেন তথাপি তার ধারণা ছিলো যতদিন ক্ষমতা প্রথাগত এবং পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের কাছে থাকবে ততদিন পাকিস্তান একত্রিত থাকবে। নয়তো দুই পাকিস্তান ভেঙ্গে যেতে সময় লাগবে। আজীবন মুসলিমদের একটা আলাদা রাষ্ট্র একটা আলাদা জাতিসত্ত্বার জন্য কাজ করে যাওয়া এই রাজনীতিবিদ তার শেষ নিঃশ্বাস পাকিস্তানে ফেলতে পারেননি। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন এবং EBDO (Election Bodies Disqualification Act) & PBDO (Public Officers Disqualification Order) জারি করেন। এর ফলে নিষিদ্ধ করা হয় সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং গ্রেফতার করা হয় সহস্রাধিক রাজনীতিবিদকে। যদিও পরবর্তিতে তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন কিন্তু স্বাস্থ্যগত সমস্যা, অর্থনৈতিক দূরবস্থা এবং স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুতে তার বার্ধক্য বেদনাবিধুর হয়ে গিয়েছিলো। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে কম আলোচিত, কিছুটা অবহেলিত এই বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ১৯৬৩ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মৃত্যুবরণ করেণ।


অনেক দুঃখের মাঝেও একটা আনন্দময় ঘটনা আমাদের জন্য এই যে, এই বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদের জানাযা অনুষ্ঠিত হয় তৎকালিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং তাকে সমাহিত করা হয় ঢাকার হাইকোর্ট প্রঙ্গনে।


রিভিউ : ইয়াকুবুল হাসান রূপম


Previous Post Next Post