দীপশেখর চক্রবর্তীর ধ্রুপদী এবং অবিচ্ছেদ্য এক বিমূর্ত সংলাপ: ‘অন্ধ বালকের ঘুমের ভেতর দেখা’
দীপশেখর চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধ বালকের ঘুমের ভেতর দেখা’ পাঠকের কাছে শুধুমাত্র কবিতার সংকলন হিসেবে আসে না; এটি এক অভিজ্ঞতার প্রতিকৃতি, এক অন্তর্দর্শনের ভেতরে প্রবেশের ধ্রুপদী যাত্রা। বইয়ের প্রতিটি পঙক্তি যেন নিঃশব্দে কথা বলে, শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্তব্ধতার মধ্যে পাঠক নিজেকে খুঁজে পায়, এমন অনুভূতিগুলোর ভেতরে যা ভাষার সীমার বাইরে প্রসারিত হয়।
গ্রন্থের শিরোনামই পাঠককে এক কল্পনাপ্রবণ প্রান্তে নিয়ে যায়। ‘অন্ধ বালকের ঘুমের ভেতর দেখা’—এই তিনটি শব্দের সমন্বয় একটি পরিপূর্ণ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। ‘অন্ধ’ চোখের অক্ষমতার প্রতীক হলেও, এখানে তা চেতনার গভীরতার ইঙ্গিত বহন করে। ‘ঘুম’ মানসিক স্থিতিশীলতার এক আবৃত স্তর, যেখানে বাস্তবতা ও অবাস্তবতার সীমা মলিন হয়ে যায়। আর ‘দেখা’—এটি চক্ষুর সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে, চেতনার আলোয় প্রতিফলিত হয়। এই শিরোনামের মধ্যে নিহিত প্রতীকী দ্বন্দ্বই বইয়ের প্রতিটি কবিতাকে গতি দেয়।
দীপশেখর যে নিখুঁতভাবে শিকড়হীনতার চিত্র রচনা করেছেন, তার এক স্পষ্ট উদাহরণ রয়েছে কবিতার এই লাইন- “তোমার শরীর জুড়ে আছে। এক আশ্চর্য শিকড়হীনতা।” এখানে শুধুই শরীর নয়, বরং অস্তিত্বের অস্থিরতা, চিহ্নহীন আত্মপরিচয়, ভাসমান সম্পর্কের অনুভূতি উপস্থিত। শরীর হয়ে উঠেছে অনুভূতির মাধ্যম, যা জড় অথচ গভীরভাবে উপলব্ধ। এই শিকড়হীনতা পাঠককে নিজস্ব অস্তিত্বের অনিশ্চয়তার সাথে মিশিয়ে দেয়।
গ্রন্থের অন্যান্য লাইনগুলোর মধ্যে “দুটি প্রসারিত হাত/ পৃথিবীর কাছে রাখা/ অশ্রুর জলে ছায়া পড়ে তার।” একটি সূক্ষ্ম বেদনার আভাস দেয়। এখানে হাতের প্রসারণ কেবল শারীরিক নয়, বরং প্রত্যাশা, অবহেলা, ভাঙা সম্পর্কের প্রতীক। অশ্রুর জলে প্রতিফলিত ছায়া দিয়ে কবি আমাদের সামনে তুলে ধরেন মানুষের ভেতরের ক্ষুদ্র কিন্তু গভীর কষ্টের পরিধি।
দীপশেখর বারবার ছোটো, সংক্ষিপ্ত লাইনগুলোর মাধ্যমে বিশাল এক আবেগের উপস্থিতি তৈরি করেন। উদাহরণস্বরূপ, “আমি ওর তৃষ্ণার জল”—সাধারণ শব্দের মধ্যেও যে ভালোবাসার নরম অথচ অপরিসীম প্রয়োজনীয়তা জড়িয়ে আছে, তা পাঠকের হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে যায়। ভালোবাসা এখানে শুধু অনুভূতি নয়, এটি জীবনের অপরিহার্যতার মতো অবধারিত। তবে সেই ভালোবাসা দুর্বল, অসম্পূর্ণ এবং নিরুপায়—একই সঙ্গে কবির নিজের ভঙ্গুর অবস্থার প্রতিফলন।
আরেকটি অসাধারণ লাইন, “প্রতিদিন সযত্নে আমি/ দুহাতের নখগুলো/ কেটে কেটে ছোট করে রাখি।” এখানে কবি আত্মনিয়ন্ত্রণ, ভয়ের উপলব্ধি এবং নিজের ভেতরের সম্ভাব্য হিংস্রতা নিয়ন্ত্রণের প্রতীকী ভাষা ব্যবহার করেছেন। এটি কেবল দৈনন্দিন অভ্যাস নয়; এটি ভেতরের অস্থিরতা ও ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে নিরব এক যুদ্ধের প্রতিচ্ছবি।
গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা যেন নীরব ঘরের কোণে লুকানো আলো। আলো কম, কিন্তু তার প্রতিটি কোণে বেদনার শব্দ যেন চুপচাপ ঘুরে বেড়ায়। “এক জীবিকা হারানো মাঝির তীব্র হাহাকার/ কান পেতে শোনা যায়।” এই দুই লাইন যেন সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত কণ্ঠকে তুলে ধরে। মাঝি এখানে শুধু মানুষ নয়; এটি হারানো উদ্দেশ্য, ছেঁড়া ছন্দ, ক্ষয়ে যাওয়া আত্মপরিচয়ের প্রতীক। কবি পাঠককে সেসব নিঃশব্দ আওয়াজ শোনান, যা প্রায়ই আমাদের ধ্বনিহীন দৈনন্দিন জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকে।
গ্রন্থের আরও এক চমকপ্রদ প্রতীকী চিত্র হলো— “একটি সাবান চিরটাকাল বন্ধ বাথরুমের সামান্য জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকবে, জীবনের মুগ্ধতার দিকে।” সাবান হয়ে যায় দর্শক। কিছু বলে না, কিন্তু দেখে যায়, অনুভব করে, এবং নিঃশব্দে আমাদের সঙ্গে সংলাপ করে। এই লাইনটি পাঠককে বিমূর্ত প্রতিচ্ছবির দিকে নিয়ে যায়, যেখানে প্রতিটি বস্তু নিজস্ব চেতনার ধারক হয়ে ওঠে।
আরেকটি চিত্রকল্প— “একটি পুরোনো বাঘ/ দুর্বল নখে ছিঁড়ে ফেলছে/ সার্কাসের নতুন পোস্টার।” এই দৃশ্য একা একটি কবিতা হয়ে দাঁড়াতে পারে। পুরোনো বাঘ স্মৃতিময়, ক্ষয়ে যাওয়া অহঙ্কার; অবহেলিত, নীরব, কিন্তু আত্মমর্যাদার সঙ্গে প্রতিবাদরত। এটি কেবল সময়ের ক্ষয় বা শক্তি হ্রাসের ছবি নয়; বরং ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে শক্তি ও জ্বলন্ত অভিমানের সংমিশ্রণ।
গ্রন্থের শেষাংশে কবি লিখেছেন— “এই দৃশ্য আয়নার মতো/ আমাদের ক্রমাগত বৃদ্ধ করে তোলে।” এই লাইন পাঠককে নিজস্ব আয়নার দিকে মুখ করে দেয়। আমাদের ক্লান্তি, ক্ষয়প্রাপ্ত সময়, হারানো সহজতা—সবকিছু এখানে প্রতিফলিত হয়। দীপশেখর এই আয়নার মাধ্যমে পাঠককে নীরবভাবে নিজেকে দেখার সুযোগ করে দেন, যেখানে প্রতিটি ক্ষুদ্র মুহূর্তের ভেতরে লুকানো বেদনা ও অস্থিরতা প্রতিফলিত হয়।
দীপশেখরের কবিতার শক্তি তার চুপচাপ অথচ গভীর ভাষায়। এখানে চিৎকার নেই, কোনো নাটকীয়তা নেই। আছে মৃদু, দীর্ঘস্থায়ী প্রতিধ্বনি, যা পাঠকের মনকে স্পর্শ করে, তাকে ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে প্রবেশ করায়। কবিতা এখানে কেবল শিল্প নয়; এটি দর্শন, স্মৃতি এবং অনুভবের এক বিস্তৃত ক্ষেত্র।
পাঠকের চোখে বইটি এক অনন্য আত্মজিজ্ঞাসার অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি লাইন, প্রতিটি চিত্রকল্প পাঠককে এমন এক নিঃশব্দ সংলাপের অংশীদার করে তোলে, যেখানে কেউ যেন আয়নার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে—নিরব, কিন্তু দৃঢ়। কবি নিজেও এই অভিজ্ঞতাকে জাগ্রত করেছেন, যেটি কেবল পাঠককে নয়, নিজের ভেতরের শূন্যতাকেও স্পর্শ করে।
দীপশেখরের ‘অন্ধ বালকের ঘুমের ভেতর দেখা’ কেবল কবিতার সংকলন নয়; এটি একটি মানসিক, আত্মিক যাত্রা। বইটির প্রতিটি পঙক্তি পাঠককে শিকড়হীনতার নিঃশব্দ আর্তির মধ্যে নিয়ে যায়। এখানে দেখা, না দেখা, অনুভব এবং অজানা—সবকিছু একত্রে একটি অনন্য বিমূর্ত অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে। শব্দ থাকে, কিন্তু আরও বেশি থাকে স্তব্ধতা, যা পড়ার পরে দীর্ঘ সময় ধরে পাঠকের মনের গভীরে বিরাজমান থাকে।
এটি এমন এক কাব্যগ্রন্থ, যা পাঠককে নীরবতার ভেতরে আলোর খোঁজ করতে শেখায়, ক্ষয়প্রাপ্ত অস্তিত্ব ও হারিয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গভীর আত্মচিন্তার পথে নিয়ে যায়। দীপশেখর চক্রবর্তী প্রমাণ করেছেন, কবিতা কেবল শিল্প নয়; এটি একটি দর্শন, একটি নিঃশব্দ সংলাপ, এবং একটি স্থায়ী স্মৃতি। ‘অন্ধ বালকের ঘুমের ভেতর দেখা’ পাঠ শেষে মনে হয়, কেউ যেন নিঃশব্দে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে—দৃঢ়, মধুর, এবং চিরস্থায়ী।
রিভিউ : রওনক জাহান মুন