ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ



ঐতিহাসিক কাহিনির টানাপোড়নে এক হারানো সময়ের গল্পঃ ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ


সমাজতন্ত্র নাকি গণতন্ত্র এই নিয়ে মানুষের মাঝে সবসময় এক ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মাঝে সমাজতন্ত্র নাকি গণতন্ত্র এই প্রশ্নের উত্তর মরীচিকার মতো। বৃহত্তর গণতন্ত্রে বাস করে সমাজতন্ত্রকে যেমন সোনার হরিণ মনে হয় তেমনি সমাজতন্ত্রের সময়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর কাছে গণতন্ত্রে প্রবেশ করা ছিল বিশাল কোন পাওয়া। 


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সরকার এবং ধনতন্ত্রে বিশ্বাসি আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সব দেশের কর্তৃত্ব নিয়েছিলো স্বাভাবিকভাবেই সে সব দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো সমাজতন্ত্র। পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং পোল্যান্ড এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পালাবদলের ইতিহাসে এই সমাজতন্ত্র ভেঙে আবার তারা গড়ে তুলেছিলো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা।


কিন্তু কেন?


সমাজতান্ত্রের সমস্যা গুলো কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লেখক চষে বেড়িয়েছেন গোটা ইউরোপ। জার্মানির অলি গলি ঘুরে বেড়িয়েছেন অার সংগ্রহ করেছেন নানা তথ্য। বুদাপেস্ট, বুখারেস্ট, ওয়ারশ, মস্কো, লেলিনগ্রাদ সহ নানা শহর ঘুরে খুঁজেছেন কেন গণতন্ত্রে ফিরে অাসা এই প্রশ্নের উত্তর। শহরের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অন্য অনেকের সাথে মত বিনিময় করেছেন। কমিউনিজমের পতনের কারণ খুঁজেছেন। নিজের চোখে অবলোকন করেছেন সমাজতান্ত্রিক দেশের অবস্থা। লেখল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা লব্ধ সেই সব জ্ঞানই স্থান পেয়েছে ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ বইয়ের পাতায়।


ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক----


বার্লিন প্রাচীরের একপাশে সমাজতন্ত্র অন্যপাশে গণতন্ত্র। এই দেয়াল ঘেসে পূর্ব ও পশ্চিমের দুটো বাড়ি একেবারে মুখোমুখি। দুই বাড়িতেই থাকে একটা করে বাচ্চা মেয়ে। তারা জানালা দিয়ে পরস্পরের সাথে কথা বলে। একদিন পশ্চিমের মেয়েটি একটি ইলেকট্রনিক খেলনা দেখিয়ে বলল, তোদের এটা আছে? পূর্বের মেয়েটি একটা সুন্দর পুতুল দেখিয়ে বলল, ওটা না থাকলে কী হয় আমাদের সুন্দর পুতুল আছে। পশ্চিমের মেয়েটি একজোড়া নতুন জুতো দেখিয়ে বলল, তোর আছে? পূর্বের মেয়েটি একটা কারুকার্য করা লেসের স্কার্ফ দেখিয়ে বলল, এটা নেই কিন্তু এটা অাছে। তোর এটা আছে? এইভাবে দুটো মেয়েই নানারকম জিনিস তুলে তুলে দেখাতে লাগল। একসময় পশ্চিমের মেয়েটি একটা পাকা কলা দেখিয়ে বলল, তোর কলা আছে? পূর্বের মেয়েটি কখনো কলা চোখেই দেখেনি। কলার বদলে অন্য কোনো ফলও দেখাবার মতো নেই বাড়িতে। সে তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, আমাদের কলা নেই কেন? মা বললেন, আমাদের কলা নেই তাতে কী হয়েছে, আমাদের কমিউনিজম আছে।


পূর্বের মেয়েটি তখন পশ্চিমের মেয়েটিকে বলল তাদের কলা নেই কিন্তু কমিউনিজম অাছে। সে কথা জানাতেই পশ্চিমি মেয়েটি একটু দমে গেল। কমিউনিজম কী তা সে জানে না, বাড়িতে তার বাবা-মা কেউ নেই তখন, জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। কিন্তু সে পশ্চিমি কনজিউমার সোসাইটির মেয়ে তো, সে জানে, পয়সা থাকলে সব কিছুই কেনা যায়। সে তখন বলল, ঠিক আছে বাবাকে বলব, আমার জন্য কমিউনিজম কিনে দেবে। তখন পূর্বের মেয়েটির মা বলল, তুমি যদি কমিউনিজম কেনো, তাহলে কিন্তু আর কোন দিন কলা পাবে না।  


নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারের জন্য দীর্ঘ লাইনের সারি চিন্তা করলেই ভাবনা থমকে যায়। হ্যা!যদি শুনেন সমাজতন্ত্রের সময়ে সামান্য সবজি কিংবা মাংস, দুধের জন্য সকাল থেকে বিশাল লাইন পড়ে যেত এমনকি গভীর রাত থেকে চলতো সামান্য দুধের জন্য দীর্ঘ লাইন তবে কি সত্যিই অবাক হবেন?


বিভিন্ন জিনিসের জন্য দীর্ঘ লাইনের সারি নিয়ে অারেকটা গল্প বলা যাক---


একবার একজন মহিলার ভিষণ অসুক হলো। কোনভাবে কেও সারাতে পারছে না। শেষমেশ এক ডাক্তারের চিকিৎসায় মহিলা ভাল হয়ে উঠলেন। দেশে সমাজতন্ত্র চলছে। সুতরাং ডাক্তারের কাজ সেবা দেওয়া এক্সট্রা খাতিরের বালায় নেই। কিন্তু মহিলা ডাক্তারকে কিছু দিতে চাইলেন। ডাক্তার তখন মহিলাকে বললেন অাপনি যদি সত্যিই কিছু দিতে চান তবে অামাকে একটি রাত দিন। ছি!ছি! এ কি কু প্রস্তাব! মহিলাটি তার স্বামীকে বললেন সে কথা। স্বামী বললেন সে তার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে তার বদলে একটি রাত এমন কিছু না। স্বামী বললেন, তার কোন সমস্যা নেই। মহিলা ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার মহিলাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেলেন। এক পত্রিকা, ম্যাগাজিনের দোকানের সামনে নিয়ে বসিয়ে রাখলেন। বললেন দোকান খোলা মাত্র পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন নিয়ে তাকে যেন পৌঁছে দেওয়া হয়। সামান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য এমন ঘটনা ঘটতো তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সমাজে।


এই যে অামরা এখন মন খুলে কথা বলতে পারছি, যা ইচ্ছে তা নিয়ে অালোচনা করতে পারছি তৎকালীন সময়ে কিন্তু এমন কল্পনাও করা যেত না। স্বাধীন ভাবে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারার কথা তারা চিন্তাও করতে পারতো না তখনকার মনুষ। এমনকি দেশের প্রতিটি মানুষের পিছনে তারা স্পাই লাগিয়ে রেখেছিল। কেও দেশ বিরোধী কথা বললে, অালোচনা করলে সাথে সাথে শাস্তি দেওয়া হবে।

এ নিয়েও অারেকটি গল্প বলা যাক----


স্কুল থেকে ছাত্র ছাত্রীদের বলা হল বাড়িতে কি বিষয় নিয়ে কথা হয় তা স্কুলে এসে জানাতে হবে। পরিবারের লোক কি নিয়ে কথা বলে, বাবা মা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন কথা বলে কিনা সব বিষয়ের কথা যেন স্কুলে জানায়। যদি কেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন কথা বলে তবে তাকে গ্রেফতার করা হবে। সামান্য স্কুলগামী ছেলে মেয়েদের স্পাই হিসাবে ব্যবহার করা হত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে।


এতশত ঘটনার পরেও যদি কখনো কাওকে প্রশ্ন করা হতো অাপনি সমাজতন্ত্র থাকুক এটা চান নাকি গণতন্ত্র তবে অকপটে সবাই বলতো সমাজতন্ত্র? এত অর্থ কষ্ট, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব তারপরেও মানুষ কেন সমাজতন্ত্র চাইতো তার সহজ উত্তর হল মানুষের ভাত কাপড়ের নিশ্চয়তা ছিল। এক কথায় সবার জন্য মৌলিক অধিকার ছিল এবং তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা ছিলো না।


বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সোভিয়েত ইউনিয়ন! একসময় এই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে কয়েকটি নতুন দেশের জন্ম হয়! সোভিয়েত ইউনিয়নের এই উথান-পতন এবং ভেঙে যাওয়ার গল্প লেখক বর্ননা করেছেন সুনিপুণ হাতে! লেখক মূলত কয়েকটি দেশের সমাজতান্ত্রিক অবস্থা এবং সে সব দেশের জনগণের সাথে ঘুরে তাদের নিকট জানতে চেয়েছেন সমাজতন্ত্রের উপর তাদের অনাস্থার কারণ কি? ঐসব দেশের কিছু লোকেরা তখনও সমাজতন্ত্র পছন্দ করত, কিন্তু তারা সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছিলো, বাক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ ছিলো সরকার!আরো অনেক কারণ আছে, পেছনে অনেক ইতিহাস অাছে, আর এই ইতিহাস-রাজনীতির খেলা জানতে হলে পড়তে হবে সুনীলের ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ।

 

ইতিহাস নিয়ে যাদের একটু অাগ্রহ অাছে তাদের সবার অাগ্রহ থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির বিভক্তি সম্পর্কে। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির বিভক্তিসূচক সেই বার্লিন প্রাচীর এখনও নীরবে-সরবে আলোচিত হয়ে থাকে। ১৯৮৯ সালে এই প্রাচীর ভাঙ্গার ঐতিহাসিক মুহূর্তে লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সেই ঐতিহাসিক কাহিনির টানাপোড়েনে শব্দের মায়াজালে খেলা করেছেন লেখক। অবশ্য এসব মনগড়া কোন গল্প নয়। লেখকের নিজের চোখে দেখা ইতিহাস।


বইঃ ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ

লেখকঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রকাশনীঃ অানন্দ পাবলিশার্স 

মূল্যঃ দুইশত সত্তর টাকা

Previous Post Next Post