![]() |
| বাংলা একাডেমি |
বঙ্গভঙ্গের পর ঢাকা বঙ্গের প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা লাভ করলে পুরাতন হাইকোর্ট ভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবন সহ দেশি-বিদেশি উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন ও অফিস নির্মাণের ধারাবাহিকতায় এই ভবন নির্মাণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান হাউস নির্মিত হয়। দ্বিতল ভবনটির পেছনে ছিলো কর্মচারী-আবাস। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় এবং ফলস্বরূপ ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা হারায়। পূর্ব বাংলার প্রভাবশালী মুসলিম নেতাদের, বিশেষশত ঢাকার নবাবদের, বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সৃষ্ট অসন্তুষ্টি দূর করার লক্ষ্য নিয়ে তৎকালীন ইংরেজ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এবং এর ফলে বাংলায় গর্ভনর নিয়োগ করা হয়। এবং বর্ধমান হাউস ছিলো সেই গর্ভনরের বাসভবন। ১৯৪৭ পর্যন্ত মূলত এটি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তাদের অতিথিশালা রূপে ব্যবহৃত হতো। ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্ধমানের মহারাজা স্যার বিজয় চাঁদ মহতাব বছরে একবার এসে এই ভবনে রাজকীয় অতিথি হিসেবে বাস করতেন।
![]() |
| রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা একাডেমিতে |
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট হতে ১৯৫৪ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বর্ধমান হাউস। পূর্ব বাংলার প্রথম দুই মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও নুরুল আমিন বর্ধমান ভবনে বাস করেছেন। ফলে পূর্ব বাংলার সরকারি কর্মপন্থা ও নীতি এই বর্ধমান হাউস থেকে পরিচালিত হতো। পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন হওয়ায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্মারক বর্ধমান হাউস। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র-শিক্ষকরা মিছিল সহকারে এ ভবনে এসে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে বর্ধমান হাউসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৮ দফা চুক্তি সাক্ষরিত হয়।
![]() |
| ভাষা আন্দোলনের সময়ে বর্ধমান হাউস |
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন এই ভবনেই বাস করতেন এবং এখান থেকে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বর্ধমান হাৎজ থেকে একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে পুলিশের কাছে গুলি চালানোর জন্য একটি লিখিত আদেশ হস্তান্তর করা হয়েছিল। এর সাথে একটি চিঠিও সংযুক্ত ছিল, যেখানে তদন্তের সীমিত সুযোগ নিয়ে ছাত্রদের অসন্তোষ উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় যে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়তো সম্ভব হবে না বা ইচ্ছাকৃতভাবে বাধাগ্রস্ত করা হবে। ফলে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বর্ধমান হাউস জনতার রোষের মুখে পড়ে এবং একে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে রূপান্তরিত করার দাবি প্রবল হতে থাকে।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে যুক্তফ্রন্ট জোট গঠিত হয়। ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানের একটি জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি এনে একুশ দফা ঘোষণা করা হয়।
এই একুশ দফার ১৬তম দফা ছিল:
“বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে কম বিলাসের বাড়িতে যুক্তফ্রন্টের প্রধান মন্ত্রীর অবস্থান করা এবং বর্ধমান হাউসকে প্রথমে ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা।”
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয় এবং নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন তার সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউস ত্যাগ করেন।১৯৫৪-এর পর থেকে বর্ধমান হাউসে ঢাকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হতো। এখানে তখন আর্ট কাউন্সিলের কার্যালয় খোলা হয়।
![]() |
| ষাট এর দশকে বাংলা একাডেমি |
বাংলা ভাষা গবেষণার উদ্দেশ্যে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান গঠনের দাবি অনেক আগে থেকে এসেছিল। ভাষা আন্দোলনের ফলে এই দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠে। ২১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথমে ১৯৫৪ সালের ৫ই এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার শিক্ষা, বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প দফতরের মন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি বর্ধমান হাউসকে একটি বাংলা ভাষা গবেষণাগার হিসেবে রূপান্তর করার উদ্দেশ্যে শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারিকে একটি পরিকল্পনা তৈরির করার নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসের চত্বরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার বাংলা একাডেমির উদ্বোধনের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন ঘটান। ৮ই ডিসেম্বর একাডেমির প্রথম কার্যালয় হিসেবে ভবনের একতলার পূর্বদিকের তিনটি কক্ষে বাংলা একাডেমির কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে সমগ্র ভবন বাংলা একাডেমির অধিকারে আসে।
ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি।



